এই সিরিজের আগের লেখা পড়ুন এখানে।
মার্চ মাসে দেশে যখন প্রথম করোনা আসল, তখনও বিএসএমএমইউতে করোনা ইউনিট খোলা হয়নি৷ খোলা হল জুলাই মাসে, পুরো কেবিন ব্লকের ৩৭০ টি বেড নিয়ে।
ঘোষনা এল যেকোন মূহুর্তে ডাক চলে আসবে, কোভিড ইউনিটে ডিউটির জন্য৷ মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এর মধ্যে এক দফা ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামও করে ফেললাম কোভিড পেশেন্ট ম্যানেজমেন্ট নিয়ে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। ডিউটির জন্য আর ডাক আসেনা। জুলাই গড়িয়ে আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর।
অবশেষে ডাক এলো…
ইতিমধ্যে নিজেদের এবং অন্যান্য ফ্যাকাল্টির লোকজন ডিউটি করছে, তাদের খবরাখবর দেখতে পাই ফেসবুকে। আর এদিকে আমি পুরোদমে অনলাইন ক্লাস, অনলাইন প্রেজেন্টেশন আর নিজ ডিপার্টমেন্টের রোস্টার ডিউটিতে মগ্ন৷
এমতাবস্থায় অক্টোবরের ১৯ তারিখ দুপুরে একটা কল আসল ফোনে৷ ফোন ধরতেই অপরপ্রান্ত থেকে জানতে চাইলেন-
-“আপনি কি ডা. মাহাবুবা রহমান?”
-“জ্বি।”
-“আপনার আগামী ২৪ তারিখ থেকে ৩০ তারিখ পর্যন্ত কেবিন ব্লকের কোভিড ইউনিটে ডিউটি।”
– “ও আচ্ছা। ঠিক আছে”
কথা বলে ফোনটা রেখে দিলাম। মাথার ভিতরে একই সাথে অনেকগুলো চিন্তা ঘুরপাক খেতে লাগল।
শুরুতে যখন এই কলটার অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম, তখন এই কল আসেনি। আসলো এমন এক সময়ে যখন আমি প্রায় ভুলতেই বসেছি আমার কখনো কোভিড ইউনিটে ডিউটি করা লাগবে। সেই সাথে মাথায় আসল বিশাল কেনাকাটার চিন্তা। কারন চৌদ্দ দিনের জন্য বাড়ি ছেড়ে থাকা যেই সেই কথা নয়।
শুকনো বচন…
এরপরের তিনদিন কাটল ঝড়ের বেগে। এর মধ্যে একদিন ছিল ওরিয়েন্টেশন প্রোগ্রাম। বাকি দুইদিন প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কিনলাম। পিপিই ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ সরবরাহ করবে জানি তবুও এক্সট্রা কিছু মাস্ক, গ্লাভস, হেড ক্যাপ, শু কাভার, হেক্সিসল, স্যানিটাইজার, কটন, মাইক্রোপোর এগুলো কিনে নিলাম। আর কিনে নিলাম কিছু শুকনো খাবারদাবার৷ এরপর শুরু হল সেগুলো লাগেজে আটানোর প্রক্রিয়া। মনের মধ্যে কেমন একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ফিল হচ্ছিল।
২৩ তারিখ শুক্রবার বিকেলে ছিল আমাদের হোটেলে চেক ইন। আমি গেলাম সন্ধ্যার পর। হোটেলে ঢুকে মোটামুটি স্বস্তি পেলাম। বেশ পরিপাটি এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রুম। রুমে যে ফ্যাসিলিটিজ গুলো আছে সেগুলোও বেশ ভাল। সমস্যা ছিল একটাই।
খাওয়াদাওয়া। রুমে খাবার দিয়ে যাওয়ার সিস্টেম ওদের ছিলনা। আমাদের প্রতিদিন নির্দিষ্ট টাইমে ওদের ডাইনিং এ গিয়ে খেতে হত। আর খাবারের আইটেমও ছিল নির্দিষ্ট।
প্রতিদিন সকালের নাস্তায় পরোটা, ডাল, সুজি, আর কখনো ডিমভাজি। দুপুরে ভাত, মাছ আর ডাল। রাতে ভাত, মুরগী, ডাল। এর মাঝে কখনো কখনো একটা মিক্সড সবজি দিত ওরা। একদিন দিল একটা ভয়াবহ তিতা শাক।
আল্লাহপাক জানেন এই অদ্ভুত শাকটা ওরা কোথায় পেল!
আমরা কেউই সেদিন ঠিকমত খেতে পারিনি। অনেকেই ভাবেন, কোভিড ডাক্তারদের যে থ্রি স্টার বা ফাইভ স্টার হোটেলে রাখছে সরকার, তাদের খাবারদাবার হিসেবে নিশ্চয়ই ওইসব হোটেলের মজাদার আইটেমগুলো দেয়া হয়। কিন্তু বাস্তবতাটা হল যে কেবলমাত্র ডিউটি পারপাসে কোথাও রাখতে হবে বলেই আমাদের এসব জায়গায় রাখা, খাওয়াদাওয়ার অবস্থা রাস্তার পাশের হোটেলগুলোর মতই, যেহেতু ওভারঅল একটা ফিক্সড বাজেটের মধ্যে সবকিছু সীমাবদ্ধ।
তো আমার মূলত খাওয়াদাওয়া নিয়ে খুব সমস্যা হত। কারন এমনিতেই আমি ডিউটিতে যাওয়ার আগে তাড়াহুড়ায় বেশি খেতে পারতাম না, প্লাস কখনো খেতে পারলেও ইচ্ছা করেই কম খেতাম যাতে বাথরুম না পায়।
কারন একবার পিপিই পড়ে ফেললে ৮-১২ ঘন্টা আর কিছুই করা যাবেনা। খাওয়াদাওয়া, বাথরুম কিছুই না। এজন্য আমরা সবাই কমবেশি ডিউটিতে যাওয়ার তিন ঘন্টা আগে থেকেই পানি খাওয়া বন্ধ করে দিতাম। বেশি পিপাসা পেলে হয়ত কেবল গলা ভিজানোর জন্য এক ঢোক, নয়ত না।
এবার আসি আমার ডিউটির অভিজ্ঞতা প্রসংগে৷
আমাদেরকে তিন শিফটে ডিউটি করতে হত- মর্নিং, ইভিনিং, নাইট।
প্রথমদিন অর্থাৎ ২৪ অক্টোবর আমার ডিউটি ছিল নাইট। নাইটের সময়কাল রাত ৯টা থেকে সকাল ৮টা- এগার ঘন্টা। সেই সাথে আসা যাওয়া, রেডি হওয়া, সব মিলিয়ে আরো দুই-তিন ঘন্টা।
তো প্রথমদিন সবার শেষের শিফটে আমি এটা ভেবেই কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছিল বুকের ভিতর। আসলে, মেডিক্যাল লাইফে ডাক্তার হওয়ার পর থেকে ডিউটি তো কম করিনি, কিন্তু এরকম ডিউটির এক্সপেরিয়েন্স জীবনে এই প্রথম।
এরকমও হয়েছে যে টানা চব্বিশ ঘন্টা ডিউটি করেছি, কিন্তু সেই ডিউটিতে ফাকে ফাকে চা খেয়ে আসতে পারতাম, পানি খেতে পারতাম, ওয়াশরুমে যেতে পারতাম, এবং সবচেয়ে বড় কথা সেইসব ডিউটিতে বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারতাম!
সেই সাথে সেসময়ের রোগীদের নিয়ে এত চিন্তা করতে হত না যে কখন আবার কোন ইমার্জেন্সি হয়! করোনা রোগীরা তো ক্ষনে ক্ষনে খারাপ হয়ে যায়। আমি কি পারব সব সামলাতে? আমাকে দিয়ে কোন অঘটন ঘটবে নাতো? বেলা যত গড়ায়, আমার মাথায় ততই এসব চিন্তা ঘুরতে থাকে আর বুক ধুকপুক করে, হাত পা অবশ হয়ে আসে।
ডাক্তারদের সুরক্ষা…
অবশেষে রাত ৮টা বাজল। ইতিমধ্যে নামকাওয়াস্তে খাওয়াদাওয়া শেষ করে রুমে চলে এসেছি। এবার ডনিং অর্থাৎ পিপিই পড়ার পালা। আমার সাথে আমার একজন ডিউটিমেট আপু থাকাতে জীবনের প্রথম পিপিই পড়াটা খুব সহজেই সম্পন্ন হল।
হোটেল থেকে গাড়িতে করে হাসপাতাল পর্যন্ত যাওয়া অত:পর ডিউটি ডক্টরস রুমে প্রবেশ, এই পর্যন্ত খুব বেশি কষ্ট হচ্ছিলনা৷ কারন মোটামুটি একটা মেন্টাল প্রিপারেশন তো ছিলই যে পিপিই পড়ে কেমন লাগতে পারে প্লাস এই জায়গাগুলোতে এসি ছিল। কিন্তু সমস্যাটা দেখা দিল যখন রাউন্ডে বের হলাম।
সিনিয়র স্যাররা ট্রেনিং এর সময়ই বলে দিয়েছিলেন পেশেন্টের রুমে ঢোকার আগে অবশ্যই তাদেরকে বলতে যেন ফ্যান, এসি এগুলো বন্ধ করে জানালা খুলে দেয়। কারন আমরা জানি করোনা ড্রপলেট ইনফেকশনের মাধ্যমে ছড়ায়। সেক্ষেত্রে ফ্যান বা এসির বাতাসে করোনা ভাইরাসের এরোসল জেনারেট হয়ে রোগীর থেকে আমাদের ইনফেকটেড হওয়ার চান্স থাকে।
সেজন্য প্রত্যেক রুমে ঢোকার আগে রোগীর এটেন্ডেন্টকে দিয়ে ফ্যান/এসি বন্ধ করিয়ে নিতে হয়েছে, ফলশ্রুতিতে দুইটা কেবিন রাউন্ড দিয়েই টের পেলাম ঝরনাধারা স্টাইলে ঘামের ধারা নেমে চলেছে আমার পিঠ, গলা বেয়ে। একপর্যায়ে আমার নিজেরই শুরু হয়ে গেল কাশি।
উপরন্তু ফেসশিল্ড নামক বর্মখানা চোখের সামনে সাটিয়ে অলমোস্ট কিছুই দেখছিলাম না। মাস্ক ভালমত সিল না হওয়ার কারনে ফগিং হচ্ছিল ব্যাপারটা সেরকম না, এমনিতেই আমার ফেসশিল্ডটা কেন জানি ঘোলা ছিল। যাই হোক, এইসব প্রতিকূলতা নিয়েও প্রায় ৪৫ মিনিটে আমার রাউন্ড কম্পলিট করলাম।
অন্যচোখে দেখা…
এবারে আসি, রাউন্ড চলাকালীন রোগী এবং রোগীর লোকদের কী কী অসচেতনতা দেখেছি।
প্রথমত, প্রায় ৭০% রোগীই মাস্ক ছাড়া বসে ছিল, তাদের পাশে তাদের যে এটেন্ডেন্ট বসা, তাদেরও একই দশা। আমি যাওয়ার পর, ইনফ্যাক্ট যাওয়ার পরও না, আমি বলার পর তারা মাস্ক পড়তেন। তাও আবার সেই মাস্ক একটু পরেই নাকের নিচে নেমে যেত।
এই অবস্থাতেই তাদের ইন ডিটেইল ফলোআপ নেয়া, অক্সিজেন স্যাচুরেশন চেক করা, অক্সিজেন ফ্লো এডযাস্ট করা এগুলো চালিয়ে গেছি। এই ঘটনাগুলো শুধু প্রথমদিনের না আসলে, যে সাতদিন আমি ডিউটি করেছি সেই সাতদিনের প্রতিদিনই এগুলো দেখতাম।
একদিনের একটা ঘটনা না বললেই না।
রাউন্ডে গিয়েছি। যে কেবিনে গিয়েছি সেই কেবিনের রোগী একজন বৃদ্ধা। বয়স ৬৫ এর কাছাকাছি। ওনার বৈশিষ্ট্য হল ওনাকে আমি কখনোই মাস্ক পরিহিত অবস্থায় পেতাম না। সাথে একেকসময় একেক এটেন্ডেন্ট থাকত এবং তারা কেউই তার কাছের কেউ না।
তো বরাবরের মত সেদিনও রুমে ঢুকে আমি ওনাকে মাস্ক পড়তে বললাম। এরপর উনার ফাইলটা হাতে নিয়ে দেখতে থাকলাম। হঠাৎ নজরে এল ওনার ফাইলে কোথাও কোভিড টেস্টের রেজাল্ট লেখা নেই৷ এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে আমি যেই ফ্লোরে ডিউটি করতাম সেই ফ্লোর ছিল সাসপেক্টেড কোভিড পেশেন্টদের জন্য। অর্থাৎ যাদের শারীরিক লক্ষনগুলোও ছিল করোনার লক্ষন সদৃশ। ভর্তির পর তাদের করোনা টেস্ট করা হত।
যাদের পজেটিভ আসত তাদেরকে পরবর্তীতে শিফট করা হত অন্য কোভিড ফ্লোরে৷ তো সেই রোগীর ফাইলে কোভিড টেস্ট সংক্রান্ত কিছু না পেয়ে আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম-
-“আপনার করোনা টেস্ট করান নাই?”
-“করাইসি তো।”
-“রিপোর্ট কই?”
বৃদ্ধা একটু চিন্তা করে বললেন,
“আমার ভাগনী জানে।”
– “আপনার ভাগ্নী কই?”
– “বাসায়।”
– “ফোন দেন তাকে।”
তখন রোগীর সাথে থাকা এক মহিলা ওনার ভাগ্নীকে ফোন দিলেন। বলা বাহুল্য, সেই মহিলারও মুখে মাস্ক ছিল না৷ জোরে জোরে কতক্ষন কথোপকথন চলল ফোনে। অতপর ফোন রাখার পর আমি জিজ্ঞেস করলাম,
– “কি বলল উনি?”
– “(বৃদ্ধার এটেন্ডেন্ট) কইল হ্যার মোবাইলে মেসেজ আইসে বলে৷”
– “কি আইসে?”
– “পজেটিভ আইসে।”
এই কথা শুনে আমারতো চোখ কপালে ওঠার জোগাড়!
রোগী কোভিড পজেটিভ, অথচ তার টেস্ট রিপোর্ট ফোনে নিয়ে বাসায় বসে আছেন ওনার লোক। একটিবারের জন্যও ডাক্তারকে জানানোর প্রয়োজনবোধ করেননি। তার উপর এই রোগী সারাদিন মাস্ক ছাড়া বসে থাকে।
ইনফ্যাক্ট এইসব কথোপকথনের পর আমি দেখলাম উনি আবারও মাস্ক খুলে বসে আছেন এবং যখন ওনাকে বললাম মাস্ক পড়তে উনি তখনো নির্বিকার। এমনকি যখন বললাম আপনার ভাগ্নীকে বলেন ওই এসএমএস টা নিয়ে এখনই চলে আসতে, তখন রোগীর উত্তর-
এভাবেই সচেতন-অসচেতন নানা রোগীর মাঝে কাটল আমার কোভিড ডিউটির ৭ দিন। এর মাঝে কোন একটা ডিউটিতেও নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকতে পারিনি৷ এই কারো স্যাচুরেশন নেমে যাচ্ছে তো এই কেউ ডিসঅরিয়েন্টেড হয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে পিপিইর ধকল তো ছিলই।
তারপরো নিজেকে মনে মনে সাহস দিতাম এই বলে যে আর মাত্র কয়েকটা দিন। দেখতে দেখতে ৭ দিন চলে যাবে। এরপর ৭ দিন শান্তিতে আইসোলেশনে থেকে বাসায় চলে যাব৷ ব্যাস। আমার কোভিড কাহিনী শেষ।
কিন্তু সেসময় একবারের জন্যও বুঝিনি, আমার কোভিড কাহিনী আসলে ওখানে শেষ না, ওটা ছিল আমার জীবনের কোভিড কাহিনীর শুরুমাত্র ..

আমি মাহাবুবা রহমান। পেশায় ডাক্তার। ছোটবেলায় কখনোই চিন্তা ছিলনা ডাক্তার হবার। আবার ডাক্তার হলেও চিন্তা ছিলনা সাইকিয়াট্রিস্ট হবার। যেমন চিন্তা ছিলনা কখনো লেখালেখি বা ব্লগিং এর। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সকল সিদ্ধান্তই নেয়া হয়েছে পূর্ব নির্ধারিত চিন্তার বাইরে। সেসব সিদ্ধান্ত নিয়ে আক্ষেপগুলোও ছিল সাময়িক। কোনকিছু নিয়ে বেশিক্ষন হতাশ থাকতে পারিনা। আশেপাশে কেউ হতাশ থাকুক সেটাও চাইনা। মূলত, এই চিন্তা নিয়েই মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক লেখালেখির শুরু। কতদূর আগাতে পারব জানিনা তবে সাইকিয়াট্রি আমার হৃদয়, আর চাইল্ড সাইকিয়াট্রি আমার ভালবাসা। ভালবাসার এই জায়গা নিয়ে ইচ্ছা আছে ভবিষ্যতে অনেকদূর আগানোর। সেই পর্যন্ত লেখালেখি চলছে, চলবে..
অনেক ভাল হয়েছে আপু
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপু কষ্ট করে পড়ার জন্য এবং মূল্যবান মতামতের জন্য। ❤️