বিগত ১০ ই নভেম্বর দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিক পত্রিকার শেষ পাতায় বেশ আকর্ষনীয় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদের শিরোনামটি ছিল এরকম- “হ্যাকারদের নিয়ন্ত্রনে হারুনের ব্রেইন!” শিরোনামের উপরে আবার ছোট করে লেখা- “মাথায় নিউরো চিপ শনাক্ত।” এবং প্রকাশিত হওয়ার মাত্র দুদিনের মাথায় মূল প্রতিবেদনটির অনলাইন শেয়ারের সংখ্যা ১৭ হাজারেরও বেশি।

সাংবাদিক সাহেব এখানে মানব মস্তিষ্ক হ্যাক সংক্রান্ত যেসব চমকপ্রদ তথ্যের অবতারনা করেছেন, সেগুলোর বিশ্লেষনে আমি যাবনা। এর কারন প্রথমত, এধরনের উচ্চতর প্রযুক্তিগত বিষয়ে আমার একেবারেই জ্ঞান নেই এবং দ্বিতীয়ত, যারা এ বিষয়ে জ্ঞান রাখেন তাদের অনেকেই ইতোমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় এর যথাযথ ব্যবচ্ছেদ করেছেন এবং নিশ্চিত করেছেন যে এখানে ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড এবং ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার বরাত দিয়ে যেসব তথ্যের অবতারনা করা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে অতিরঞ্জিত এবং বিকৃত।
ঠিক যেরকম কিছুদিন আগে আমাদের দেশের আরেকটি নামীদামী দৈনিক পত্রিকা ল্যান্সেট জার্নালের বরাত দিয়ে লিখেছিল, করোনা ঠেকাতে নাকি মাস্ক পড়ার কোন প্রয়োজন নেই!
সে যাই হোক, ব্যক্তি হারুন যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন সেটা যদি আমি সাইকিয়াট্রির আলোকে বিশ্লেষন করতে যাই তবে আমাদেরকে জানতে হবে সিজোফ্রেনিয়া (Schizophrenia) সম্পর্কে।
সিজোফ্রেনিয়া কী?
সিজোফ্রেনিয়াকে বলা হয়ে থাকে মানসিক রোগসমূহের মধ্যে খুব গুরুতর একটি রোগ। মানসিক রোগগুলোকে মোটা দাগে দুইটি ভাগে ভাগ করা যায়- ১. সাইকোসিস ও ২. নিউরোসিস। নিউরোসিস হল রোগী যখন নিজেই বুঝতে পারে যে তার কোনো একটা মানসিক সমস্যা হচ্ছে এবং এর জন্য চিকিৎসা প্রয়োজন।
অন্যদিকে সাইকোসিস হচ্ছে রোগী যখন নিজের মানসিক সমস্যা সম্পর্কে নিজে বুঝতে পারেনা, সে নিজেকে সম্পূর্ন সুস্থ ভাবে এবং কোন চিকিৎসার আওতায় আসতে চায়না। এই দুয়ের মধ্যে সিজোফ্রেনিয়া, সাইকোসিসের অন্তর্ভুক্ত।
সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষনসমূহ
সিজোফ্রেনিক রোগীর বেশ কিছু লক্ষনের মধ্যে দুটি উল্লেখযোগ্য লক্ষন হচ্ছে ডিলিউশান এবং হ্যালুসিনেশান।
ডিলিউশান (Delusion) এর সহজ বাংলা হচ্ছে একধরনের ভ্রান্ত ধারনা যা ব্যক্তি মনেপ্রানে বিশ্বাস করে, যদিওবা সেই বিশ্বাসের স্বপক্ষে কোন যথাযথ প্রমান সে দিতে পারেনা অথবা তার সামনে এই বিশ্বাসের বিপরীতে যথেষ্ট প্রমানাদি রাখা স্বত্ত্বেও সে তার বিশ্বাসে অটল থাকে।
ডিলিউশান হতে পারে অসংখ্য রকমের, যেহেতু মানুষের চিন্তার বা ধারনার কোন পরিধি নেই তাই ‘ভ্রান্ত ধারনার’ও কোন শেষ নেই। এই ডিলিউশানের মধ্যে খুব সচরাচর যেটা পাওয়া যায় সেটা হল “Delusion of persecution“, অর্থাৎ যেখানে ব্যক্তি বিশ্বাস করে যে তার পরিচিত কিংবা অপরিচিত কোন মানুষ কোন এক উপায়ে তার ক্ষতি করার/মেরে ফেলার/তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু একটু খোজ নিলে দেখা যাবে ব্যক্তির এই ধরনের সন্দেহ একেবারেই অমূলক এবং এই বিষয়ে যতই তাকে বোঝানো হোক না কেন সে সেটা মানতে নারাজ।
অন্যদিকে হ্যালুসিনেশান (Hallucination) এর একটি কঠিন বাংলা অর্থ- ‘অলীক প্রত্যক্ষন’। আর সহজ বাংলা হচ্ছে, আমরা প্রকৃতির যেকোনো কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করি আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় (চোখ, কান, নাক, জিহবা, স্পর্শ) দিয়ে। এখন যদি এমন হয় যে, কোনো একটি বস্তু যার কিনা বাস্তবে কোন উপস্থিতি নেই কিন্তু আপনার ইন্দ্রিয় সেটা একেবারে বাস্তব অনুভুতির মতই অনুভব করতে পারছে তখন সেটাকে বলা হয় হ্যালুসিনেশান। হ্যালুসিনেশান যেহেতু ইন্দ্রিয়ের সাথে সম্পর্কিত তাই ইন্দ্রিয় অনুসারে এদের নামকরন করা হয়েছে- Auditory hallucination, Visual hallucination ইত্যাদি।
সিজোফ্রেনিক রোগীদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে কমন হ্যালুসিনেশান হচ্ছে অডিটরী (Auditory) হ্যালুসিনেশান যেটাকে আমরা গায়েবী কথা বলি। ‘গায়েবী’ বলা হয় কারন, সিজোফ্রেনিক রোগী বাস্তবে অস্তিত্ব নেই কিংবা অস্তিত্ব থাকলেও উপস্থিতি নেই এরকম ব্যক্তির কথা স্পষ্ট শুনতে পান এবং এই ক্ষেত্রে সাধারনত যেই ব্যক্তিকে সে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী ভাবে (Delusion of pesecution), সেই ষড়যন্ত্রকারীর কন্ঠ বা ষড়যন্ত্রমূলক বিভিন্ন কথাবার্তা, তাকে উদ্দেশ্য করে গালিগালাজ, আদেশ উপদেশ ইত্যাদি বিভিন্ন কিছু শুনতে পান যার ফলে তার সন্দেহপ্রবনতা আরো বেড়ে যায়।
এছাড়াও সিজোফ্রেনিক ব্যাক্তিদের মধ্যে আচরনগত অস্বাভাবিকতা (disorganized behaviour), কথাবার্তায় অসংলগ্নতা (disorganized speech) কিংবা এগুলোর কোনোটাই না থেকে কিছু negative symptoms যেমন সবার থেকে আলাদা হয়ে একা থাকা, নিজের যত্ন না নেয়া, কথাবার্তা বন্ধ করে দেয়া ইত্যাদি লক্ষনসমূহও থাকতে পারে।
এখানে কিছু বিষয় জানা থাকা প্রয়োজন, যেমন জাতি, গোষ্ঠী বা সমাজভেদে অনেক জায়গায় কিছু বিশ্বাস প্রচলিত আছে যেমন মুসলিমরা বিশ্বাস করেন জ্বিন জাতিতে, হিন্দুরা বিশ্বাস করেন পূনর্জন্মে। জ্বিন বা পূনর্জন্ম কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমান করার কোন উপায় নেই। তারমানে কি এই গোষ্ঠীর লোকেরা ডিলিউশনাল?
আবার অনেকসময় আমাদের অনেকের এইধরনের অনুভুতি হয় যে হঠাৎ কী জানি দেখলাম বা কী জানি শুনলাম, পরক্ষনেই আবার বুঝতে পারি যে সেটা ছিল আমাদের দেখার বা শোনার ভুল। অনেকে এটাকে আবার হ্যালুসিনেশান নাম দিয়ে বসেন। আসলে কী এগুলো হ্যালুসিনেশান?
উত্তর হচ্ছে “না”। উপরের কোনোটাই ডিলিউশান বা হ্যালুসিনেশান না। কেন না সেটার বিস্তারিত বর্ননায় গেলে আমাদের আর হারুন সাহেবের গল্পে ফেরা হবেনা।
শুধু এতটুকু জেনে রাখি যে সিজোফ্রেনিয়া অনেক জটিল এবং বিস্তর একটি বিষয়। দুই চার লাইনে সিজোফ্রেনিয়া বা অন্য কোন মানসিক রোগই বুঝে ফেলা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে আপনার করনীয় কেবল এটুকুই যে, যদি আপনার কখনো সন্দেহ হয় আপনার পরিবার বা পরিচিত কারো মানসিক সমস্যা হচ্ছে তবে সাথে সাথে তাকে একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যাওয়া। এতটুকু দ্বায়িত্ব তো আমরা পালন করতেই পারি।
হারুন সাহেবের গল্পের ব্যাখ্যা
হারুন সাহেবের সন্দেহ তার শ্যালিকা আসমাউল হোসনা আতিকুর রহমান নামক আরেক ষড়যন্ত্রকারীর সংগে হাত মিলিয়ে মাথায় মাইক্রোচিপ বসিয়ে ওনার ব্রেইন হ্যাক করেছে। ফলে ওনার যাবতীয় গোপন তথ্য উনি না চাইতেও হ্যাকারদের কাছে চলে যাচ্ছে। সেই সাথে উনি গায়েবী আওয়াজের ব্যাপারেও বলেছেন। উনি বিভিন্ন গায়েবী গালিগালাজ শুনতে পান, সেই সাথে আবার তাকে নাকি নানারকম হুমকিও দেয়া হচ্ছে ইদানীং বেশি বাড়াবাড়ি না করার জন্য!
পুরো ঘটনাটাকেই ডিলিউশান এবং হ্যালুসিনেশান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়। বিশেষ করে এই যে হ্যাকার চক্র দূর থেকে তার সবকিছু নিয়ন্ত্রন করছে, এই বিশ্বাসকে বলে ডিলিউশান অব কন্ট্রোল ( Delusion of control) যেখানে ব্যক্তি বিশ্বাস করেন যে তার নিজের সকল কর্মকান্ড, আবেগ, ইচ্ছা-অনিচ্ছা আর তার নিজের অধীনে নেই, বাইরে থেকে কেউ সব নিয়ন্ত্রন করছে। এবং এই ডিলিউশান অব কন্ট্রোল সিজোফ্রেনিয়া ডায়াগনোসিসের ক্ষেত্রে অনেক বেশী গুরুত্ব বহন করে।
এবারে আসি সাংবাদিক সাহেবের প্রসংগে। আমাদের সাংবাদিক সাহেব লিখেছেন “যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা Low Frequency Micro-chip শনাক্তকারী উবারপব দ্বারা হারুনের মাথায় নিউরো চিপের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে।” সেই সাথে হারুন সাহেব নাকি বিদেশী একজন ডাক্তারের পরামর্শে কয়েকবার MRI করানোর পর সেখানে মাইক্রোচিপের অস্তিত্ত্ব পাওয়া গেছে।
এখন আমার প্রশ্ন হল এই বিষয়গুলো কি সাংবাদিক সাহেব ভেরিফাই করে লিখেছেন নাকি হারুন সাহেবের মুখের কথাতেই লিখে ফেলেছেন? অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র থেকে উবারপপ কে এনেছে? সেটি দিয়ে কবে, কখন, কে মাইক্রোচিপটি শনাক্ত করল? যেখানে আজকাল ছোট থেকে বড় সব ঘটনাই মানুষ ভিডিও করে রাখে সেখানে মানব ব্রেনে মাইক্রোচিপ পাওয়া সংক্রান্ত এতবড় একটা ঘটনার কোন ভিডিও কেউ করল না?
দ্বিতীয়ত, বিদেশী যে ডাক্তারের কথা বলা হচ্ছে তিনি আসলে কে? নাম কি তার? যে MRI তে মাইক্রোচিপ পাওয়া গেছে সেই MRI কি সাংবাদিক সাহেব নিজ চর্মচোখে দেখেছেন?
উনি হারুন সাহেবের বিষয়টি নিয়ে এতজন মানুষের সাথে কথা বললেন- এসআই, পুলিশ সুপার এমনকি একজন নিউরোসার্জনের কাছেও গিয়েছেন, কিন্তু ওনার একবারও মনে হলনা এই বিষয়টি নিয়ে একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলা উচিত?
সর্বোপরি, এইধরনের সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে আবারো প্রমানিত হল যে মানসিক স্বাস্থ্য বা মানসিক সমস্যা বিষয়ে আমরা জাতিগতভাবে কতটা উদাসীন। সেই সাথে গনমাধ্যমকর্মীদের দ্বায়িত্বশীলতার প্রশ্ন তো আসেই।
তবে আমি বিশ্বাস করি আমাদের যারা গনমাধ্যমে কাজ করেন- সাংবাদিক, সংবাদকর্মী বা অন্যান্য যারাই আছেন প্রত্যেকেই নিজ নিজ জায়গায় যথেষ্ট দ্বায়িত্ববান। সবার আগে সর্বশেষ সংবাদ কিন্তু তারাই আমাদের কাছে পৌছান। তাদের প্রতি তাই সাধারন মানুষের আস্থাটাও অনেক।
এই আস্থার কথা চিন্তা করে হলেও সংবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে তাদের আরো সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। কারন এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে একটি সংবাদ ভাইরাল হওয়া কয়েক মিনিটের ব্যাপার মাত্র। সেক্ষেত্রে একটি সঠিক সংবাদ প্রচার হওয়ার কৃতিত্ত্ব যেমন তাদের, একটি ভুল সংবাদ ভাইরাল হওয়ার দায়ভারও তারা এড়াতে পারেননা।

আমি মাহাবুবা রহমান। পেশায় ডাক্তার। ছোটবেলায় কখনোই চিন্তা ছিলনা ডাক্তার হবার। আবার ডাক্তার হলেও চিন্তা ছিলনা সাইকিয়াট্রিস্ট হবার। যেমন চিন্তা ছিলনা কখনো লেখালেখি বা ব্লগিং এর। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সকল সিদ্ধান্তই নেয়া হয়েছে পূর্ব নির্ধারিত চিন্তার বাইরে। সেসব সিদ্ধান্ত নিয়ে আক্ষেপগুলোও ছিল সাময়িক। কোনকিছু নিয়ে বেশিক্ষন হতাশ থাকতে পারিনা। আশেপাশে কেউ হতাশ থাকুক সেটাও চাইনা। মূলত, এই চিন্তা নিয়েই মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক লেখালেখির শুরু। কতদূর আগাতে পারব জানিনা তবে সাইকিয়াট্রি আমার হৃদয়, আর চাইল্ড সাইকিয়াট্রি আমার ভালবাসা। ভালবাসার এই জায়গা নিয়ে ইচ্ছা আছে ভবিষ্যতে অনেকদূর আগানোর। সেই পর্যন্ত লেখালেখি চলছে, চলবে..
বৈজ্ঞানিক, সহজপাঠ্য ও সময়োপযোগী!
চমৎকার!
অনেক ধন্যবাদ আপু! 🥰