দুপুর তিনটা বাজে দশ মিনিট। ইভিনিং ওপিডিতে বসে আছি আমি আর এসোসিয়েট প্রফেসর হারুন স্যার৷ তনিমারও থাকার কথা ছিল, হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ায় আসতে পারেনি। কাউকে রিপ্লেসও দিতে পারেনি। এদিকে অন্যসব দিনের চাইতে আজকে রোগীও বেশি মনে হচ্ছে৷ মনে মনে চরম রাগ লাগতে থাকল।
এমনিতে ইভিনিং ওপিডি খুব একটা খারাপ লাগেনা আমার। ইভিনিং ওপিডিতে মূলত কন্সালটেন্টরাই চিকিৎসা দেন, আমাদের কাজ হল রোগীদের হিস্ট্রি নিয়ে স্যারের কাছে প্রেজেন্ট করা। মিনিমাম দুইজন রেসিডেন্ট থাকলে কাজটা গায়ে লাগেনা৷ একা হয়ে গেলেই বিপদ। যেমন আজকে আমি বিপদে পড়েছি।
‘শিরিন, রোগী তো বেশি মনে হচ্ছে৷’
‘জ্বি স্যার, আজকে রোগী একটু বেশিই।’
‘তাহলে এক কাজ করো৷ সবার হিস্ট্রি তুমি নিওনা৷ আমি সরাসরি কিছু রোগী দেখে ফেলি আর বাকিদের তুমি হিস্ট্রি নিয়ে আমার কাছে আনো। তাহলে তাড়াতাড়ি হবে।’
যাক বাবা! একটু স্বস্তি পেলাম। হারুন স্যার অবশ্য এরকমই ভালমানুষ। স্যারকে কখনো মুখ ফুটে সমস্যার কথা বলতে হয়না, নিজেই বুঝে নেন। আমি ‘জ্বি স্যার’ বলে রোগীদের টিকেটগুলো থেকে অর্ধেক স্যারের টেবিলে দিলাম। বাকিদের হিস্ট্রি নিজে নিতে থাকলাম।
প্রায় ৩ টা হিস্ট্রি নিয়ে ফেলেছি, এমন সময় হঠাৎ হারুন স্যার একটা প্রেসকিপশান আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন-
‘দেখোতো শিরিন, এই প্রেসকিপশানে কোন সমস্যা আছে নাকি।’
আমি প্রেসকিপশানটা হাতে নিয়ে দেখলাম আমার হাতের লেখা। নিজে ইংরেজিতে গোটা গোটা অক্ষরে আমার সিগনেচার, “ডা. শিরিন”। ওষুধের নামগুলো পড়লাম মনে মনে, ” ইনজেকশন ফেনাজিন, ট্যাবলেট ডাইসোপ্যান….” হায় হায়! ফেনাজিনের সাথে পার্কিনিল কই!
ফেনাজিনের সাথে পার্কিনিল দেয়া হয় ফেনাজিনের সাইড ইফেক্ট কাটানোর জন্য। আমি সেটা দেইনি৷ এরকম একটা ভুল আমি কিভাবে করলাম?
স্যারের দিকে তাকিয়ে দেখলাম স্যার মাথা নিচু করে মিটিমিটি হাসছেন। সামনে বসা রোগীর দিকে তাকালাম, দেখি শক্ত হয়ে বসে আছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে রোগী ‘ইপিএসই’ নিয়ে এসেছে। আমার শিড়দাড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। মনে মনে ভাবলাম, আমার রেসিডেন্সি কোর্সের যাত্রা বোধহয় আজকেই শেষ! স্যার কী এখন আমাকে বাংলা ভাষায় গালি দিয়ে বিদায় করবেন না ইংরেজি ভাষায় দিবেন সেটাই চিন্তা করছি।
প্রেসকিপশানটা আমার হাত থেকে নিলেন স্যার৷ কিছু বললেন না৷ সম্ভবত সব রোগী দেখা শেষে আমাকে ঝাড়বেন। আমার কী বলা উচিত সেটা এখনই ঠিক করা দরকার।
রোগী দেখা শেষ হল চারটা বিশে। স্যার যখন শেষ রোগীটা দেখছিলেন, আমি তখন মনে মনে ঝাড়ি খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
অতঃপর শেষ রোগীটাও দেখা শেষ হয়ে গেল। স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘চলো তাহলে ওঠা যাক?’
আমি খুব অবাক হলাম। স্যার আমাকে কিছুই বললেন না? স্যার মনেহয় আমার চেহারা দেখেই বুঝলেন আমি যে এত অবাক হয়েছি।
‘তুমি কি কিছু বলতে চাও শিরিন?’
‘না মানে স্যার…. আমি সরি।’
‘কী জন্য বলতো?’
‘ স্যার ওই যে স্যার পার্কিনিল….…’ আমি মিনমিন করতে লাগলাম।
‘ও আচ্ছা! এটা কোন বিষয় না। এত চিন্তা করার প্রয়োজন নেই৷ বাসায় যাও।’
আমি ঘটনা কিছুই বুঝলাম না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম৷ স্যার হেসে ফেললেন। একবার ঘড়ির দিকে তাকালেন। তারপর আবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘আচ্ছা, বোসো। তোমাকে একটা গল্প শুনাই। যদি তোমার কোন তাড়া না থাকে তো।’
‘না না স্যার। আমার কোন তাড়া নেই।’
‘তাহলেতো খুবই ভাল। আমার অবশ্য একটা কাজ আছে। তবে সেখানে ঘন্টাখানেক লেট করে গেলেও সমস্যা নেই। এই মূহুর্তে তোমাকে গল্পটা বলা বেশি জরুরি মনে হচ্ছে আমার। যে গল্পটা আমি বলব, সেটা আমার জীবনের একটা গল্প। সব গল্পের একটা নাম থাকে। ধরে নাও আমার এই গল্পের নাম “ভুল”।’
‘ভুল?’
‘হ্যা ভুল। আজকে তুমি তোমার একটা ভুল নিয়ে খুব লজ্জায় পড়ে গেছ তাইনা? হ্যা এটা ঠিক যে তোমার আরেকটু সতর্ক হওয়া প্রয়োজন ছিল কিন্তু তারপরও এটা খুব বড় কোন ইস্যু না। তুমি চাইলেই এই ভুলটা আবার শুধরে ফেলতে পারবে। যে ওষুধটা লিখতে ভুলে গেছো, সেটাই আগামী কয়েকদিন পেলেই রোগী সুস্থ হয়ে যাবে। কিন্তু জীবনে কখনো কখনো এমন কিছু ভুল আমরা করে ফেলি যেগুলো আর কখনোই শোধরানো যায়না।
আমার গল্পের মূল চরিত্রের নাম মনোয়ার। মনোয়ার ছিল সিজোফ্রেনিক। আমি তখন তোমার মত সাইকিয়াট্রির একজন ট্রেইনি। সেটা আজ থেকে প্রায় বিশ বছর আগের কথা৷
আমি এখন গল্পটার যেই অংশ বলব, সেটা মনোয়ারের থেকে শোনা৷ আমি আমার ভাষায় বলছি।
মনোয়ারের রোগটা যখন শুরু হয় তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৩ বছর। বগুড়ার দরিদ্র পরিবারের সন্তান মনোয়ার। বাবা মারা গেছে ছোটবেলায়। ধান মাড়াইয়ের মেশিন চালাতেন বাবা৷ সেই মেশিনেই একদিন মারাত্মকভাবে জখম হয় হাত। টাকার অভাবে সুচিকিৎসা কপালে জোটেনি। ফলাফল, হাত পচে পুরো শরীরে সেপসিস ছড়িয়ে পড়ে। মরে যাবার আগে মনোয়ারের মাকে বলে গিয়েছিলেন, যত কষ্টই হোক তার ছেলেটাকে যেন পড়াশুনা করানো হয়। মৃত্যুপথযাত্রী বাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন মা। হয়ত কোনবেলা না খেয়ে থেকেছেন কিন্তু মনোয়ারের পড়াশুনা চালিয়ে গেছেন৷ মনোয়ারও ছিল মেধাবী। স্কুল কলেজে ভাল রেজাল্ট করে মেধা আর পরিশ্রমের জোরে ভর্তি হয় ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে।
মনে আছে মনোয়ারের, প্রথম যেদিন ভর্তি পরীক্ষার ফর্ম নিতে ঢাকা আসে, অবাক হয়ে গিয়েছিল। একটা ইউনিভার্সিটি বলে এত বড় হয়! এত সুন্দর হয়! ক্যাম্পাসের মাঝখান দিয়ে রাস্তা, রাস্তার দুপাশে সারি সারি গাছ, মাঝখান দিয়ে আবার কতশত গাড়ি ঘোড়াও যাচ্ছে। মনে মনে সেদিনই ঠিক করে ফেলে, পড়াশুনা করলে এইখানেই করবে৷ তার মা সবসময় বলে, “বড় জায়গায় থাকলে মনটাও বড় হয়।” মনোয়ারের সেদিন মনে হয়েছিল, মন বড় করার এই সুযোগ কোনভাবেই হাতছাড়া করা উচিত না।
সৃষ্টিকর্তা মনোয়ারের ইচ্ছা পূরন করলেন৷ ভর্তি পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে ভর্তি হল ‘ক’ ইউনিটের কোন একটি সাবজেক্টে৷ এরপর হলে ওঠার পালা৷ বাড়ি গিয়ে বিছানা- বালিশ, বইপত্র গুছিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হবে যেদিন, সেদিন মাকে সাহস করে একটা কথা বলেছিল সে।
বলেছিল ইলমাকে সে ভালবাসে। ইলমা তার ফুফাতো বোন। অনেক আগে থেকেই পছন্দ করে দুজন দুজনকে৷ ইলমার কথা বলতে গিয়ে মনোয়ারের একটু ভয় লাগছিল। মা যদি রেগে যায়! তার বিধবা মা ফিরোজা বেগম অবশ্য খুশিই হয়েছিলেন সেদিন। ছেলের বিয়ে নিয়ে তার সবসময়ই দুশ্চিন্তা ছিল। একা মানুষ তিনি। তারউপর বয়স হয়েছে৷ ছেলের জন্য উপযুক্ত পাত্রী খোজা, বিয়ের আয়োজন করা এসব উনি কিভাবে করবেন? কিন্তু এখন যখন ছেলের নিজের পছন্দই আছে, তখন আর চিন্তা কী! তাও আবার নিজেদেরই মেয়ে। ইলমাকে তো ছোটবেলা থেকেই চেনেন। এমন ভাল মেয়ে আর হয়না৷
কয়েকদিনের মধ্যেই বিয়ে হয়ে গেল মনোয়ার আর ইলমার। ইলমা তখন বগুড়া সরকারী কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ে আর মনোয়ার থাকে ঢাকা ভার্সিটির হলে। বিয়ের পর প্রতি সপ্তাহে একদিন করে বাড়ি যেত মনোয়ার৷ বৃহস্পতিবার ক্লাস করে রওনা দিত, শুক্রবার সারাদিন থেকে আবার সন্ধ্যায় বাসে উঠত। মাত্র কয়েক ঘন্টার জন্য ইলমাকে কাছে পেত সে। এই কয়েক ঘন্টার জন্য সারা সপ্তাহ অপেক্ষা করত মনোয়ার৷ ক্যাম্পাসের সবাই এই নিয়ে খুব ক্ষ্যাপাতো ওকে৷
ওদিকে সপ্তাহের বাকি পাচদিনের প্রতিদিন অপেক্ষা করত গভীর রাতের, যখন হলের সব বাতি বন্ধ হয়ে যাবে, মনোয়ার পা টিপে টিপে বারান্দায় এসে ফোন দেবে ইলমাকে। তখন নতুন নতুন মোবাইলের যুগ। সাড়ে সাত টাকা কলরেট। এই কলরেটে চার পাচ মিনিটের বেশি কথা বলা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার, তারপরও কোনদিন ইলমার সাথে কথা বলা বাদ যেতনা তার। রাতে একমিনিটের জন্য হলেও ইলমার কন্ঠ তার শোনা চাই।
একবার খুব জ্বর হল মনোয়ারের৷ জ্বরের দুদিন আগ থেকেই শরীর খারাপ ছিল তার। কিন্তু ইলমাকে সেসবের কিছুই জানায়নি সে। ভেবেছে বাচ্চা মেয়ে, অযথাই দুশ্চিন্তা করবে। দুদিন পর সকালবেলা উথাল পাথাল টেম্পাচার নিয়ে জ্বর আসল। এদিকে কখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা আর সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হল, মনোয়ার জানেনা। জ্বরের ঘোরে সে বেহুশপ্রায়। সেদিন সারারাত ইলমা বসে ছিল মনোয়ারের ফোনের অপেক্ষায়। নিজেও কয়েকবার ফোন দিয়েছে, মনোয়ার ধরেনি।
পরদিন মনোয়ারের বন্ধুরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। ডাক্তার দেখে জানালেন মূত্রথলির ইনফেকশন হতে পারে, ভর্তি করে চিকিৎসা করতে লাগলেন।
তিনদিন পর মনোয়ারের শরীর যখন কিছুটা ভাল, হাসপাতালে বসেই ফোন দিয়েছিল ইলমাকে। ফোন ধরে ইলমার সে কী রাগ! মনোয়ারের কোন কথাই শুনবেনা। মনোয়ার উপায়ন্তু না দেখে বলে ফেলল নিজের অসুস্থতার কথা। মূহুর্তেই ইলমার রাগ পরিনত হল কান্নায়। বাচ্চাদের মত হাউমাউ করে কেদেছিল সেদিন মেয়েটা। কিছুতেই শান্ত করা যাচ্ছিল না৷ বারবার বলছিল একটাই কথা, “তোমার কিছু হলে আমি মরে যাব! আমি মরে যাব!” নিজেকে সেদিন খুব সুখী মানুষ মনে হয়েছিল মনোয়ারের। বারবার চোখ ভিজে যাচ্ছিল। কিন্তু পুরুষমানুষের নাকি কাদতে নেই, নইলে নির্ঘাত সেদিন সেও ইলমার সাথে গলা মিলিয়ে কাদত।
মনোয়ারের অসুখটা শুরু হয় বিয়ের ঠিক একবছর পর। তখনো সে হলেই থাকত। দুদিন বাদে ইয়ার ফাইনাল, তাই পড়াশুনার খুব চাপ। সেদিন বিকেলে রুমে বসে পড়াশুনা করছিল। সাথে আর কেউ ছিলনা। সন্ধ্যা প্রায় হয়ে আসছে, দিনের আলো কমতে শুরু করেছে। এমন সময়ে রুমের বাতি জ্বালানোর জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়াল মনোয়ার। সুইচবোর্ডটা ছিল জানালার কাছে। সেদিকে এক পা এগুতেই হঠাৎ প্রচন্ড ভয় হতে লাগল তার। মনে হচ্ছিল জানালার ওপাশে ঘাপটি মেরে কিছু একটা বসে আছে। খুব খারাপ কিছু। জানালার কাছে গেলেই ভয়ংকর কিছু ঘটবে।
মনোয়ার একছুটে রুম থেকে বের হয়ে গেল। একনিশ্বাসে সিড়ি দিয়ে দৌড়ে নিচে নামল। নামার সময় মনেহচ্ছিল ওই বস্তুটা তার পিছন পিছন আসছে। একবারের জন্যও মনোয়ার পিছন ফিরে তাকায় নি। তিনতলা সিড়ি ভেংগে হলের সামনের মাঠে এসেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। মাঠের কিছু ছেলে এরপর ধরাধরি করে ওকে রুমে এনে শুইয়ে দেয়।
কতক্ষন অজ্ঞান ছিল মনোয়ার জানেনা। তবে জ্ঞান ফেরার পর সেদিন সারারাত সে আর ঘুমাতে পারেনি। রুমমেট সাইদও তার সাথে জেগে ছিল সেদিন।
এরপর থেকে প্রতিদিন একটু একটু করে অস্বাভাবিক হতে শুরু করে মনোয়ার। বন্ধুবান্ধব, রুমমেট সবাইকে ভীষন সন্দেহ হতে থাকে, সবাইকে শত্রু মনেহয়। সন্দেহের বশে ক্যাম্পাসে যাওয়াও বন্ধ করে দেয় একসময়। সারারাত জেগে থাকত। একা একা হাসত, একা একা কথা বলত৷
সেবার ইয়ার ফাইনালটা আর দেয়া হয়না মনোয়ারের। পড়াশুনাটাই আর হয়নি। বাড়ি চলে আসে। কিছুদিন বাড়িতে কবিরাজের ঝাড়ফুক চলে৷ গ্রামের বিখ্যাত পান্ডু কবিরাজ, কোহকাফ নগরীর জ্বিনরা যার কথায় ওঠে বসে৷ তার সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল মনোয়ারের শ্বাশুড়ির কাছ থেকে। লোকমুখে শোনা যায় এই পান্ডু কবিরাজ নাকি আগে অন্য এক গ্রামে পানের দোকানদার ছিল। অবশ্য পীর-সন্ন্যাসীদের নিয়ে মানুষ বরাবরই কুৎসা রটনা করে। মন্দ লোকের মন্দ কাজ আরকি। ওসবে কান দিলে চলে না।
পান্ডু কবিরাজের মাধ্যমেই জানা গেল ইউনিভার্সিটির কোন এক মেয়ে মনোয়ারকে তাবিজ করেছে। মনোয়ারকে সেই মেয়ে ভীষনভাবে কামনা করে কিন্তু মনোয়ারের দিক থেকে কোন সাড়া না পেয়ে প্রতিশোধপরায়ন হয়ে মেয়েটির এহেন আচরন। তবে চিন্তার কোন কারন নেই, পান্ডু কবিরাজের কাছে এইসব ওয়ান টুর ব্যাপার। শুধু তার চিকিৎসায় বিশ্বাস রাখতে হবে আর কিছু শর্ত মানতে হবে। একটি শর্ত ছিল রোগী সম্পূর্ন সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত স্ত্রীর সংগ নিষেধ। কিন্তু রোগী যেহেতু উন্মাদ ,সেহেতু এই শর্ত অক্ষরে অক্ষরে পালনের দ্বায়িত্ব ছিল রোগীর স্ত্রীর।
কিন্তু ইলমা শর্ত পালন করতে পারেনি। মনোয়ার বাড়ি ফেরার চার মাসের মধ্যে ইলমা গর্ভবতী হয়ে পড়ে।
মনোয়ারের মা ভেবে পেল না, ইলমা এতবড় একটা আহাম্মকি কিভাবে করতে পারল! পাড়া প্রতিবেশীরাও অবাক। এদিকে মনোয়ারের অবস্থা দিনকে দিন খারাপ হতে লাগল। যখন তখন উলংগ হয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়, লোকজন দিয়ে খুজে বের করে ঘরে আনতে হয়৷ কবিরাজকে কিছু জিজ্ঞাসা করলে কবিরাজ চোখ বন্ধ করে বলে, “নিয়মভংগ হয়েছে, সেজন্য চিকিৎসা কাজ করতেসে না।” ইলমার প্রতি সবার রাগ আরো বেড়ে গেল।
শেষপর্যন্ত ঠিক হল কবিরাজের চিকিৎসা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ইলমা তার বাবার বাড়ি থাকবে। ইলমার মাকে খবর দিয়ে আনানো হল মেয়েকে নিয়ে যাবার জন্য৷
চলে যাবার দিন ইলমা খুব কেদেছে। অনেক কাকুতি মিনতি করেছে। তাকে যেন এই বাড়িতে থাকতে দেয়া হয়। সে মনোয়ারের থেকে আলাদা ঘরে থাকবে, মনোয়ারের কাছে যাবেনা, শুধু দূর থেকে মনোয়ারকে দেখবে। কিন্তু মনোয়ারকে এই অবস্থায় রেখে সে কিছুতেই যেতে চায়না। কিন্তু বাচ্চা মেয়েটার কোন কথাতেই সেদিন কারো মন গলেনি৷
শ্বশুরবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার দিন ইলমা বারবার পেছন ফিরে তাকিয়েছে। মনোয়ার তখন উঠোনে হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে। মাথা ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে কথা বলছে আর হাসছে একা একা। ইলমাকে দেখে একবার ইলমার দিকে তাকিয়েও হাসল। ইলমার ইচ্ছা করছিল ছুটে গিয়ে মনোয়ারকে জড়িয়ে ধরতে। মানুষটা যে বাবা হতে যাচ্ছে, এই খুশির খবরটা সে জানবে না? জীবনের সবচাইতে খুশির মূহুর্তে তাদের দুজনকে আলাদা করে দেয়া হল, কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছিল ইলমার।
বাবার বাড়িতে গিয়ে ইলমা ভীষন অসুস্থ হয়ে পড়ল। কী জানি হল মেয়েটার। খাওয়া নেই, ঘুম নেই, মুখে আগের মত হাসি নেই। চোখের নিচে কালি পড়েছে, শরীর শুকিয়ে কাঠ। কারো সাথে কোন কথা বলত না, শুধু নীরবে চোখের পানি ফেলত।
প্রেগন্যান্সির দুইমাসের মাথায় ইলমার এবরশান হয়ে গেল।
আমার কাছে মনোয়ার আসে তার অসুখ শুরুর প্রায় ৬ মাস পর। সেদিন আমার ইভিনিং ডিউটি ছিল। দেখলাম ইয়াং একটা ছেলেকে চার পাচজন মানুষ ধরে নিয়ে এসেছে। ছেলেটার গায়ে কোন কাপড় নেই, শুধু একটা প্যান্ট পড়া। তাও বারবার টেনে তুলতে হচ্ছে, কারন ছেলেটা এতই শুকনা যে কোমড় থেকে প্যান্ট নেমে যাচ্ছে।
ইন্টারেস্টিং বিষয় হল, ছেলেটা দেখতে অসম্ভব সুন্দর। টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ, পুরুষমানুষ সাধারনত এত ফর্সা হয়না। মাথাভর্তি মিশমিশে কালো চুল। মনে হচ্ছিল হূমায়ুন আহমেদের “শুভ্র”কে চোখের সামনে দেখছি। অনেকদিনের অপরিচ্ছন্নতা আর অযত্নের ছাপ শরীরে, তাও সৌন্দর্য খুব বেশি ম্লান হয়নি।
ছেলেটার সাথের বাড়তি লোকজনকে বের করে দিয়ে শুধুমাত্র তাকে আর তার মাকে বসিয়ে হিস্ট্রি নেয়া শুরু করলাম।
‘কী নাম তোমার?’
অস্পষ্ট স্বরে উত্তর এল, ‘মনোয়ার।’
‘মনোয়ার কেমন আছো?’
মনোয়ার কিছু বলল না। মাথা নিচু করে হাসতে থাকল।
‘হাসছো কেন মনোয়ার?’
‘কিছুনা৷ এমনেই।’ বলতে গিয়ে কিছুটা লালা গড়িয়ে পড়ল মুখের পাশ দিয়ে৷
বুঝলাম পেশেন্টের থেকে হিস্ট্রি নেয়াটা খুব সহজ হবেনা৷ আমি মায়ের সাথে কথা বলা শুরু করলাম। কিভাবে অসুখ শুরু হল, এখন কি কি সমস্যা, সব। মায়ের থেকে হিস্ট্রি নিয়েই ধারনা করা গেল পেশেন্টের সিজোফ্রেনিয়া। তারপরও হ্যালুসিনেশান, ডিলিউশান নিশ্চিত হওয়ার জন্য পেশেন্টকে ক্রস করা শুরু করলাম। হ্যালুসিনেশন ক্রস করতে গিয়ে খুব ইন্টারেস্টিং একটা বিষয় পেলাম-
‘আচ্ছা মনোয়ার, মনে করো তুমি একা বসে আছো, আশেপাশে কেউ নেই, কিন্তু কানে স্পষ্ট কথা শুনতে পাচ্ছো, এরকম হয়?’
‘জ্বি না৷’
‘একটু চিন্তা করে বলো মনোয়ার৷ তুমি নাকি প্রায়ই একা একা কারো সাথে কথা বলো, বিড়বিড় করো। সেটা তাহলে কার সাথে?’
‘অ ওইটা.. ওইটা তো মহক্কত!’
‘মহব্বত?’
‘না না। মহক্কত।’
‘মহক্কত কে?’
‘মহক্কত হইল গিয়া আপনার একটা পাখি!’ বলে একটা চওড়া হাসি হাসল মনোয়ার। কী সুন্দর হাসি ছেলেটার!
‘মহক্কত তোমাকে কী বলে? একটু বলোতো।’
‘বলে তো কত কিছুই। গল্প বলে, গান বলে, এটা সেটা করতে বলে।’
‘ মহক্কতের কথা শুনতে তোমার ভাল লাগে?’
‘জ্বি লাগে৷’
‘কেন লাগে?’
‘ওইযে বললাম। আমার সাথে অনেক গল্প করে। গান শুনায়৷’
‘একটা দুইটা গল্প বলো দেখি।’
মনোয়ার এবার একটু লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেলল,
‘সেসব গল্প আমি বলতে পারব না। ভালবাসার গল্প।’
‘মহক্কত তোমার সাথে ভালবাসার কথা বলে?’
‘জ্বি।’
‘কিন্তু মহক্কত তো একটা পাখি। পাখি কি মানুষের মত কথা বলতে পারে?’
‘সবাই পারে না। মহক্কত পারে৷ তার অনেক গুন।’ মনোয়ার আবার হাসল।
এরপর আরো কিছুক্ষন কথাবার্তা বলে আমি মনোয়ারের এডমিশন অর্ডার লিখে দিলাম। আমার ইউনিটেই ভর্তি হয়েছিল সে৷ প্রায় দুইমাস ভর্তি ছিল। এই দুইমাস প্রতিদিন আমি তার ফলোআপ দিতাম।
অল্প সময়েই মনোয়ার ওষুধে রেস্পন্স করে। কিন্তু সমস্যা ছিল সে সবসময় ওষুধ খেতে চাইতো না। নয়ত আরো আগেই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেত।
যেদিন ছুটি পাবে সে, তাকে চেনা যাচ্ছিল না একদম! ক্লিন শেভড ফতুয়া-প্যান্ট পড়া একেবারে জেন্টেলম্যান যেন। যদিও ছুটির সময়ও অল্প কিছু সিম্পটম ছিল তার। তুমিতো জানোই সিজোফ্রেনিয়ার রোগী সম্পূর্ন ভাল হয়ে বাড়ি যায়, এমন ঘটনা রেয়ার। তবে বাসায় গিয়ে নিয়মিত ওষুধ খেলে আর ফলোআপে আসলে যে তার অসুখটা আরো উন্নতির দিকে যাবে এটা ভালমত বুঝিয়ে দিয়েছিলাম আমি। যাওয়ার সময় মনোয়ারের মা আমাকে অনেক দোয়া দিয়ে গেল।
এরপর অনেকদিন মনোয়ারের সাথে আর দেখা হয়নি। মাঝে মধ্যে মনে পড়ত ছেলেটা কি আর ফলোআপে আসল না? পরক্ষনেই আবার মনেহত, হয়ত অন্য কোন দিন আসে, যেদিনগুলোতে আমি আউটডোরে বসিনা।
দিন যেতে লাগল আর আমিও একটা সময় মনোয়ারকে বলতে গেলে ভুলেই গেলাম।
এর প্রায় এক বছর পর আমি মর্নিং আউটডোরে বসে আছি। আমার কাছে একজন রোগী আসল, সুইসাইডাল এটেম্পটের হিস্ট্রি নিয়ে। রোগী আমাকে দেখে “স্যার!” বলে কেদে ফেলল। আমি প্রথমে তাকে চিনতে পারিনি। কাগজপত্র দেখার পর মনে পড়ল। এ যে আমাদের মনোয়ার!
মনোয়ারের স্বাস্থ্য আগের চেয়ে ভাল হয়েছিল, তবে চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ৷ সিজোফ্রেনিয়া তখন নিয়ন্ত্রণে, কিন্তু ফুল ব্লোন ডিপ্রেশন নিয়ে এসেছিল সে। সাথে সুইসাইডাল এটেম্পট। গলায় দড়ি দিতে গিয়েছিল, মা দেখে ফেলায় রক্ষা।
পোস্ট-সিজোফ্রেনিক ডিপ্রেশন বেশ কমন জানো নিশ্চয়ই। আমি তাই খুব একটা অবাক হলাম না। তবে মনোয়ারের সুইসাইডালিটি এসেস করে দেখলাম তার স্ট্রং সুইসাইডাল ইন্টেন্ট আছে। আমি ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিলাম। কিন্তু মনোয়ার কোনভাবেই ভর্তি হতে রাজি না৷ খেয়াল করলাম সে কেমন যেন উসখুস করছে। সম্ভবত আমি যা যা জানতে চেয়েছি তার বাইরেও কিছু বলতে চায়। কিন্তু পাশে মা থাকায় বলতে সংকোচ করছে। আমিও আর বেশি সময় দিতে পারলাম না। ওষুধ লিখে দিয়ে বললাম তিন সপ্তাহ পর যেন অবশ্যই আবার ফলোআপে আসে।
এর একমাস পর একদিন ইনডোরে মনোয়ার এসে হাজির। আমার সাথে কথা বলতে চায়। আমি তাকে বললাম আউটডোরে যেতে, ভাবলাম হয়ত ফলোআপের জন্য এসেছে। কিন্তু মনোয়ার জানালো সে ফলোআপ নিয়েই এসেছে। আমার সাথে একটু কথা বলতে চায়, খুব নাকী জরুরী। আমি মনে মনে একটু বিরক্তই হলাম। বললাম, যদি বেশি লম্বা কথা হয় তাহলে যেন অপেক্ষা করে৷ মর্নিং আওয়ার শেষ হওয়ার আগে আমি কথা বলতে পারব না৷
দুপুরে ওয়ার্ডের কাজ শেষে যখন বের হচ্ছিলাম, দেখলাম ওয়ার্ডের সামনের বেঞ্চিতে মনোয়ার বসা। কী সর্বনাশ! সে কী সত্যিই এতক্ষন ধরে অপেক্ষা করছে? আমি মনোয়ারকে ডেকে ভিতরে নিয়ে আসলাম।
তারপর বলো মনোয়ার, কী অবস্থা তোমার?
মনোয়ার কোন উত্তর না দিয়ে একটা শুকনো হাসি হাসল। আমার বুকটা ধক করে উঠল। মনোয়ারের হাসিতো এমন না। কী জানি কী কষ্ট ছেলেটার বুকে, হয়ত কাউকে বলতে পারছেনা। তার কষ্টের কথাটা আমার জানা প্রয়োজন।
‘তোমার কী হয়েছে মনোয়ার?’
‘আমি আপনাকে একটা গল্প বলতে চাই স্যার।’
‘তুমি কী আমাকে গল্প শোনাতেই এসেছ?’
‘জ্বী স্যার।’ মনোয়ারের কন্ঠে গাঢ় বিষাদ।
‘আচ্ছা বলো শুনি।’
এরপর মনোয়ার আমাকে যে গল্পটা শোনাল সেটা আমি তোমাকে অলরেডি বলে ফেলেছি। মনোয়ারের অসুখ শুরু হবার গল্প, ইলমার গল্প। আমি অবাক হয়ে গেলাম মনোয়ারের গল্প বলার ধরন দেখে৷ কে বলবে এই ছেলে সিজোফ্রেনিক! কী চমৎকার আর্টিকুলেশন!
তোমাকে আমি ইলমার গর্ভপাত হওয়ার ঘটনা পর্যন্ত বলেছি তাইনা? তারপরের অংশ এখন বলছি। তার আগে বল, চা খাবে?
‘না স্যার। আপনি প্লিজ গল্পটা শেষ করুন।’
‘আচ্ছা তাহলে আমি আমার জন্য এককাপ চা আনাই।’
স্যার আয়াকে ডেকে এককাপ চা আনাতে দিলেন। এরপর শুরু করলেন গল্পের বাকি অংশ-
ইলমা তার বাবার বাসায় চলে যাওয়ার পর মনোয়ারের বাড়িতে কবিরাজী চিকিৎসা চলতে থাকে। কিন্তু মনোয়ারের অবস্থা দিনকে দিন শোচনীয় হতে থাকে। একদিন দা নিয়ে মনোয়ার কবিরাজকে মারতে যায়। সেদিন কবিরাজ নিজেই মনোয়ারের মাকে জানায়, ওনার ছেলেকে ভাল করা তার সাধ্যের মধ্যে নেই, তারা যেন মনোয়ারকে ঢাকা নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করায়।
মনোয়ার এরপর আমাদের কাছে আসে, ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয়।
তোমাকে বলেছি, এন্টিসাইকোটিকে মনোয়ারের রেস্পন্স বেশ ভাল ছিল। অল্প সময়েই সে ইন্সাইট ফিরে পায়। হাসপাতাল ছাড়ার সময়ইমনেমনে ঠিক করে নেয় বাড়ি ফিরে ইলমাকে আনতে যাবে৷ ইলমার বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার ঘটনা তার মনে আছে। ইনফ্যাক্ট, তখনকার প্রায় সব ঘটনাই সে মনে করতে পারে কিন্তু ইন্সাইট না থাকায় সেসময় ঘটনাগুলো উপলব্ধি করার মত কগনিশন তার ছিলনা। এখন বুঝতে পারে, কী অন্যায়টাই না হয়েছে ইলমার সাথে।
হাসপাতালে থাকাকালীন মাকে কয়েকবার ইলমার কথা জিজ্ঞাসা করেছে সে, প্রতিবারই মা বলেছেন আগে সে সুস্থ হয়ে বাসায় যাক, তারপর এসব নিয়ে আলোচনা করা যাবে। বাড়ি যাওয়ার খুব তাড়া ছিল তাই মনোয়ারের৷
কিন্তু বাড়ি ফেরার পর মনোয়ার যা জানল, সেটা সে কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি।
জানতে পারল, ইলমা আর এই গ্রামে নেই৷ ইনফ্যাক্ট ইলমা এই দেশেই নেই। ইতালী প্রবাসী এক লোকের সাথে নাকী তিনমাস আগে ইলমার বিয়ে হয়৷ বিয়ের একসপ্তাহ পরই ইলমা স্বামীর সাথে ইতালি চলে যায়।
মনোয়ার যখন এই কথাগুলো শুনছিল তার মনেহচ্ছিল সে যা শুনছে সব মিথ্যা। ইলমাতো তার বিবাহিতা স্ত্রী, ওর কিভাবে আবার বিয়ে হবে?! মনোয়ারের মা জানাল, ইলমার বাবা মা চায়নি কোন পাগলের সাথে থেকে তাদের মেয়ের জীবন নষ্ট হোক। তাও যদি পেটের সন্তানটা বাচত, হয়ত তারা আরেকবার চিন্তা করতেন। কিন্তু বাচ্চাটাও তো নষ্ট হয়ে গেল, এরপর আর এইদিকে ফিরে আসার কোন মানে নাই।
প্রথমবারের মতন সেদিন মনোয়ার এটাও জানতে পারল যে ইলমার গর্ভে তার সন্তান এসেছিল। তার একবার মনে হল সে হয়ত কোন দুঃস্বপ্ন দেখছে। অসুখটা শুরু হবার পর থেকে সে প্রায়ই দুঃস্বপ্ন দেখে। নয়ত একটা বছরে, মাত্র একটা বছরে তার সাজানো জীবনটা এভাবে নষ্ট হয়ে গেল?
গল্পের এতটুকু বলার পর মনোয়ার চুপ হয়ে গেল। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না কী বলব।
গল্পটা কি এখানেই শেষ মনোয়ার?
‘জানি না স্যার।’
‘তুমি আসলে আমার কাছে কেন এসেছ বলতো?’
মনোয়ার কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে হঠাৎ আমার দুহাত চেপে ধরল।
‘স্যার আপনি আমাকে বাচান! আমি আর পারিনা স্যার। বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রনা হয়। যন্ত্রনা শেষ করার জন্য মরতে চেয়েছি, কিন্তু ভাগ্য আমাকে মরতেও দেয়না। প্রতিটা দিন, প্রতিটা মূহুর্ত আমার জন্য একেকটা অভিশাপ..’
‘দেখো মনোয়ার, তুমি ডিপ্রেশনে ভুগছো। আমি জানি এই মূহুর্তে তোমার কী পরিমান কষ্ট হচ্ছে। তুমি কি ওষুধগুলো খাচ্ছো?’
মনোয়ার আমার কথা শুনলই না যেন, আপনমনে বলেই যাচ্ছে…
‘প্রতিটা মানুষের জীবনে কিছু না কিছু থাকে স্যার, যেটার জন্য সে বাচে। আমারো ছিল। ভালবাসা ছিল, বন্ধু ছিল, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ছিল। এখন এগুলোর কোনটাই নেই। আমি সারাদিন ঘরের বাইরে থাকি। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরি, পাড়ার চায়ের দোকানে বসে থাকি তবু ঘরে আসিনা। কেন জানেন স্যার? যেই মূহুর্তে চৌকাঠে পা রাখি বুকটা হাহাকার করে ওঠে। চিৎকার করতে কাদতে ইচ্ছা হয়। কবরস্থানে যারা শুয়ে থাকে, তাদের চেয়েও বেশী নিঃসংগ আমি.. আচ্ছা স্যার, সিজোফ্রেনিয়া না হয়ে ক্যান্সার হতে পারত না আমার? একবারে মরে যেতাম!’
‘মনোয়ার শান্ত হও। আমাকে বল, তুমি কী ডিপ্রেশনের ওষুধগুলো খাচ্ছনা?’
মনোয়ার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
‘এইসব ওষুধ খেয়ে কী হবে স্যার? আপনার কাছে কোন স্মৃতি নষ্ট করার ওষুধ থাকলে দেন। যতদিন আমার স্মৃতি বেচে থাকবে, ততদিন এই যন্ত্রনা আমার পিছু ছাড়বেনা।’
আমি চুপ করে রইলাম। কিছু বলার ভাষা পাচ্ছিলাম না। মনোয়ারের কথাগুলোর মধ্যে কিছু একটা ছিল। প্রচন্ড কষ্ট হতে লাগল আমার।
‘স্যার, আমার একটা উপকার করবেন?’
‘কি উপকার?’
‘আমার সিজোফ্রেনিয়ার ওষুধগুলোর ডোজ কমিয়ে লিখে দিবেন?’
‘মানে? ডোজ কেন কমাব?’
‘স্যার আমি দেখেছি, ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিলে মহক্কত আমার সাথে কথা বলে।’
আমি চমকে উঠলাম। বলে কী এই ছেলে!
‘তুমি কী বলতে চাচ্ছো স্পষ্ট করে বলো।’
‘স্যার প্লিজ, একটু বোঝার চেষ্টা করুন।’ মনোয়ার আমার দুহাত আরো জোরে চেপে ধরল।
‘আমার জীবনের একমাত্র সংগী এখন মহক্কত। ইলমার ঘটনাটা জানার পর আমি কয়েকদিন খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলাম। ওষুধও খেতামনা। ওই সময়টাতে হঠাৎ একদিন খেয়াল করলাম মহক্কত আবার কথা বলতে শুরু করেছে। আগের মত মজার মজার গল্প শুনায়, গান শুনায়। এবং আশ্চর্যজনকভাবে মহক্কতের গলার স্বর এখন অনেকটা ইলমার মত লাগে।’
‘তুমি কি আর এখন ওষুধ খাচ্ছোনা মনোয়ার?’
‘না স্যার, ওষুধ খাই৷ ছাড়তে পারিনাই। কয়দিন বাদ দেয়ার পর আম্মা আবার জোর করে খাওয়ানো শুরু করে। এখন আর মহক্কত কথা বলেনা।’ মনোয়ারের কন্ঠে গভীর হতাশা।
‘ওষুধ ছাড়া যাবেনা মনোয়ার। তুমি জানোনা সিজোফ্রেনিয়া একটি মারাত্মক অসুখ।’
‘ ওষুধ ছাড়ব না স্যার। আপনি শুধু প্রেসকিপশানে আমার ডোজটা কমিয়ে দিবেন। যে ডোজে মহক্কত আমার সাথে কথা বলবে।’
‘সেটা তো তুমি নিজেও করতে পার। আমাকে কেন কমাতে হবে?’
‘না, পারিনা স্যার। আম্মা আপনার উপর অনেক ভরসা করে। আমার অসুখটা যেমন ছিল, আম্মা কোনদিন ভাবেন নাই আমি স্বাভাবিক হব। সেই আমাকে আপনি স্বাভাবিক করে দিয়েছেন। এখন আপনার প্রেসকিপশানে যা আছে, প্রয়োজনে আম্মা পানিতে গুলিয়ে, খাবারে মিশিয়ে হলেও সেই ডোজ আমাকে খাওয়াবেই। আম্মার সাথে আমি প্রতিদিন যুদ্ধ করতে পারব না। আপনি যদি শুধু আমার ডোজটা একটু কমিয়ে দেন তাহলেই আর আমার কোন কষ্ট থাকেনা। প্লিজ স্যার!’
বলতে বলতে মনোয়ারের চোখ চকচক করছিল।
এবার আমি একটু কঠিন হলাম।
‘মনোয়ার তুমি এতক্ষন ধরে যে কথাগুলো বললে, তা একই সাথে অযৌক্তিক এবং ভয়ানক। এধরনের কিছুই আমি করব না। তুমি এখন আসতে পার।’
একথা বলে আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালাম। প্রায় সাথে সাথেই মনোয়ার আমার পায়ে লুটিয়ে পড়ল।
‘স্যার প্লিজ, আপনাকে কিছুই লিখতে হবেনা। শুধু আম্মাকে বলবেন, শরীর সুস্থ লাগলে লাগলে আমি মাঝেমাঝে ওষুধ কমিয়ে খেতে পারব। প্লিজ স্যার, প্লিজ!’
মনোয়ার শক্ত করে ধরে রেখেছিল আমার পা। আমি রাজি না হওয়া পর্যন্ত কিছুতেই পা ছাড়বেনা। এরকম সমস্যায় আমি এজীবনে কখনো পড়িনি! ছেলেটার জন্য কষ্ট হচ্ছিল ভীষন, কিন্তু ডাক্তার হিসাবে নিজের এথিকস তো আমি ভাংগতে পারিনা!
এইটুকু বলে স্যার থামলেন। ইতোমধ্যে স্যারের চা চলে এসেছে। স্যার চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করে একটা চুমুক দিলেন।
‘ বাহ! খুব ভাল হয়েছে চা টা। তুমি কি চা খাওনা নাকি শিরিন?’
‘স্যার তারপর কি হল?’
‘ কিসের তারপর?’
‘ আপনার গল্পের।’
‘গল্প তো শেষ!’
‘ কিন্তু আপনার ভুলটা কী ছিল?’
স্যার হাসলেন। আমিতো তোমাকে বুদ্ধিমতী ভেবেছিলাম শিরিন। তোমার তো বোঝার কথা আমি তারপর কী ভুল করেছিলাম।
‘তারমানে মনোয়ারের মাকে আপনি তাই বলেছিলেন যেটা মনোয়ার বলতে বলেছিল?!’
স্যার আমার কথার জবাব দিলেন না। চোখ বন্ধ করে আরেকটা চুমুক দিলেন।
‘মনোয়ারের সাথে কি আর দেখা হয়েছিল আপনার?’
এবার স্যার চোখ মেললেন।
‘না। ওই ঘটনার প্রায় ছয় মাস পর মনোয়ারের মা এসেছিল আমার কাছে। মনোয়ার সুইসাইড করেছিল। একটা পাচতলা বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে লাফ দেয় সে।’
‘কিন্তু কেন!’
‘সেটা আমি জানিনা শিরিন। তবে আমার ধারনা মহক্কত বলেছিল তাকে কাজটা করতে।’
‘মানে?’
‘মানে আমি ধরে নিয়েছি ওইদিনের পর থেকে মনোয়ার ওষুধ খেত না কিংবা খেলেও ডোজ কমিয়ে খেত। আর তোমার মনে আছে কিনা জানিনা, মনোয়ার যখন প্রথম আমার কাছে আসে তখন সে বলেছিল, মহক্কত তাকে এটা সেটা করতে বলে। অর্থাৎ “কমান্ড হ্যালুসিনেশন” ছিল ওর৷ তুমিতো জানো কমান্ড হ্যালুসিনেশন কতটা ভয়ংকর হতে পারে৷’
‘হুম্মম..’
‘মনোয়ারের মা সেদিন আমাকে খুব দোয়া করেছিলেন। আমার প্রতি অনেক কৃতজ্ঞ ছিলেন তিনি। তার ছেলে যতদিন বেচেছিল, আমার উসিলাতেই নাকি বেচেছিল। দোয়া করলেন আল্লাহ যেন আমার নেক হায়াত হায়াত দারাজ করেন।’
বলতে বলতে স্যারের ঠোঁটের কোনে একটা বিদ্রুপের হাসি ফুটল যেন..
আমি চুপ করে বসে রইলাম। কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। স্যার ঘড়ির দিকে তাকালেন।
‘ সাড়ে পাচটা বেজে গেছে! চলো বের হই।’
স্যার উঠতে গিয়েও আবার বসে পড়লেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘শিরিন!’
‘জ্বি স্যার৷’
‘একটা কথা সবসময় মনে রাখবে, জীবনের সবক্ষেত্রে র্যাশনাল মাইন্ড আর ইমোশোনাল মাইন্ডের ব্যালেন্স করে চলাটা খুব জরুরী। মানুষকে ভালবাসবে, খুব ভালবাসবে, কিন্তু সেই ভালবাসায় যেন শুধু আবেগের আধিপত্য না চলে। মনে রেখ, ইউ হ্যাভ টু বি ক্রুয়েল, অনলি টু বি কাইন্ড..’
এইবার স্যার উঠলেন। আমিও উঠলাম।
হাসপাতালের বাইরে বের হয়ে দেখলাম দিনের আলো পড়তে শুরু করেছে। বসন্তের মিষ্টি বাতাসে শরীর জুড়িয়ে গেল। আজকের বিকেলটা একটু বেশিই সুন্দর মনেহয়। আমি হাটতে লাগলাম। মাথার মধ্যে শুধু একটা কথাই বাজতে থাকল-
“I have to be cruel only to be kind
Thus bad begins and worse remains behind…”

আমি মাহাবুবা রহমান। পেশায় ডাক্তার। ছোটবেলায় কখনোই চিন্তা ছিলনা ডাক্তার হবার। আবার ডাক্তার হলেও চিন্তা ছিলনা সাইকিয়াট্রিস্ট হবার। যেমন চিন্তা ছিলনা কখনো লেখালেখি বা ব্লগিং এর। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সকল সিদ্ধান্তই নেয়া হয়েছে পূর্ব নির্ধারিত চিন্তার বাইরে। সেসব সিদ্ধান্ত নিয়ে আক্ষেপগুলোও ছিল সাময়িক। কোনকিছু নিয়ে বেশিক্ষন হতাশ থাকতে পারিনা। আশেপাশে কেউ হতাশ থাকুক সেটাও চাইনা। মূলত, এই চিন্তা নিয়েই মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক লেখালেখির শুরু। কতদূর আগাতে পারব জানিনা তবে সাইকিয়াট্রি আমার হৃদয়, আর চাইল্ড সাইকিয়াট্রি আমার ভালবাসা। ভালবাসার এই জায়গা নিয়ে ইচ্ছা আছে ভবিষ্যতে অনেকদূর আগানোর। সেই পর্যন্ত লেখালেখি চলছে, চলবে..
sad story apu 😥
😞😞😞
অনেক সুন্দর লেখা।
খারাপ লাগছে মনোয়ারের জন্য। করো জীবনে যখন বাস্তব মানুষের কথার চেয়ে অবাস্তব হ্যালুসিনেশন আপন হয়ে যায় তখন কি পরিস্থিতির তৈরি হয় সেটা আমরা বাইরের মানুষ যদি বুঝতাম!
অনেক ধন্যবাদ মুনিম এত সুন্দর উপলব্ধির জন্য! ❤️
খুব সুন্দর গল্প আর লেখনী
অনেক অনেক ধন্যবাদ ধৈর্য্য ধরে পড়াএ জন্য। ❤️
সুন্দর গল্প 😊
অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনারা কমেন্ট করলে লেখার উৎসাহ পাই। 😊
অসাধারণ গল্প
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনার মূল্যবান মতামতের জন্য ❤️❤️❤️
সুন্দর লিখেছ।
আপু! থ্যাংক ইউ সো মাচ! 😍😍😍
Share dite pari?Khub koshter ekta lekha..
অবশ্যই শেয়ার করতে পারেন আপু। ❤️
অসাধারণ লেখা!
মুগ্ধ হয়ে পড়ার মতো.. ❤️❤️
অসংখ্য ধন্যবাদ! ❤️
অসাধারণ লেখা!!
মুগ্ধ হয়ে পড়ার মতোই.. ❤️❤️
অসংখ্য ধন্যবাদ!!!! 😍😍😍
পড়তে পড়তে এক মুহূর্তের জন্যও মনে হয় নি থেমে যাই। অসাধারণ আপু।
অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া এত সুন্দর কমেন্টের জন্য৷ আপনাদের এমন কমেন্ট পেলে লেখার উৎসাহ পাই। ❤️
মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শেষ করলাম 😍
অসংখ্য ধন্যবাদ আপু। আপনাদের এমন মন্তব্য আমাকে উৎসাহ দেয়। ❤️❤️❤️
ম্যাম আমি আপনার একজন ক্ষুদে পাঠক । Psychology আমার ভীষণ পছন্দের বিষয়। আমি হুমায়ূন আহমেদ স্যারের একজন ভক্ত। তাঁর লেখার সাথে আপনার লেখার সাদৃশ্য রয়েছে। ভীষণ ভালো লেগেছে আপনার গল্প। শুভকামনা রইল।
আমিও হুমায়ূন স্যারের ভীষন ভক্ত এবং উনার লেখা দ্বারা ভীষনভাবে প্রভাবিত! 😍 তবে আমি গল্প লিখতে পারিনা। হুমায়ূন স্যারের মত তো প্রশ্নই ওঠে না! এই গল্পটা আসলে আমি একটা ছোট্ট সত্য ঘটনা দিয়ে প্রভাবিত হয়ে লিখেছি। আপনার ভাল লেগেছে শুনে ভাললাগল। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ❤️❤️❤️